Gostho gopal das biography of alberta
শহর দেয়নি ঠাঁই, গ্রামবাংলা কিন্তু আজও বুকে আঁকড়ে রেখেছে গোষ্ঠ গোপাল দাসকে
নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: Nineteenth October 2022 15:56
শহর দেয়নি ঠাঁই, গ্রামবাংলা কিন্তু আজও বুকে আঁকড়ে রেখেছে গোষ্ঠ গোপাল দাসকে
রূপাঞ্জন গোস্বামী
শহর ছাড়িয়ে গ্রামবাংলায় পা রাখলেই শুরু হয়ে যায় তাঁর সাম্রাজ্য। গ্রামবাংলায় তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সেখানে তিনিই একমেবাদ্বিতীয়ম। বিশ্বাস না হলে, কোনও এক গভীর রাতে গ্রামবাংলার যেকোনও স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, খেয়াঘাট বা গঞ্জের বাজারে চলে যান। কোনও না কোনও রাত জাগা দোকান থেকে নিশ্চিত ভাবে আপনার কানে ভেসে আসবে, "চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কী", "ঘুমায়ো না আর বেহুলা জাইগা থাকো রে", " ও নাগর কইয়া যাও, কোন বা দেশে যাও, আমার পরান কান্দে" কিংবা সেই মানুষটির গাওয়া কোনও না কোনও গান।
ক্রমশ আপনাকে সম্মোহিত করতে থাকবে, সোঁদা মাটির গন্ধ মাখা গানগুলি। আপনি অনুভব করবেন, গ্রামবাংলার মেঠো পরিবেশের সঙ্গে মানুষটির গেয়ে যাওয়া গানগুলির একাত্মতা। ঠিক এই কারণেই, প্রায় পাঁচ দশক ধরে তাঁর প্রাণ কাঁদানো গানের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও মফঃস্বলগুলিকে সম্মোহিত করে রেখেছেন কিংবদন্তি লোকশিল্পী গোষ্ঠ গোপাল দাস (Gostho Gopal Das)। যাঁর গানের ছত্রে ছত্রে কেবলই জীবনযন্ত্রণা ও বিষাদ। তাই বুঝি তিনি স্পর্শ করতে পেরেছেন গ্রামবাংলার হৃদয়। আপনার মনে পড়বে ইংরেজ কবি শেলির সেই অমর উক্তি, “Our sweetest songs program those of saddest thought.”
অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার কোনও এক অখ্যাত গ্রামে, ১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি জন্ম নিয়েছিলেন গোষ্ঠগোপাল। বাবা দীনবন্ধু দাস ও মা হরিদাসীও ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের। দিনাজপুর থেকে দীনবন্ধু চলে এসেছিলেন হুগলির লক্ষ্মণপুর গ্রামে। সেখানেই কেটেছিল গোষ্ঠগোপালের শৈশব। দীনবন্ধু তাঁর ছেলেকে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে শিখিয়েছিলেন বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, জারি ও মারফতি গান। মেঠো পথে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময়, গলা ছেড়ে গান গাইতেন কিশোর গোষ্ঠগোপাল। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ পেরিয়ে যেত মাঠের পর মাঠ। ধান বোনা বন্ধ করে, তন্ময় হয়ে তাঁর গান শুনতেন কৃষকের দল।
মানুষের রক্তমাংসের শরীরের যে চেতনা সদা জাগ্রত থাকে, সেটি হল আত্মা। বাউলেরা সারা জীবন ধরে সেই আত্মার খোঁজে পাগলপারা হয়ে ঘুরে ফেরেন পথে পথে। গোষ্ঠগোপালও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই যুবক হওয়ার পর রহস্যের মোড়কে মোড়া বাউল গানেই সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। ইতিমধ্যে জীবনে এসে গিয়েছিলেন গীতাদেবী। কিন্তু সংসারে তখন প্রবল দারিদ্র। বাধ্য হয়ে গোষ্ঠগোপাল গান গাইতেন পথে ঘাটে, ট্রেনে, স্টেশনে ও বাস স্ট্যান্ডে। কখনও একা। কখনও মাজন বা জড়িবুটি বিক্রেতাদের সঙ্গ নিয়ে।
মধুর সন্ধানে সুগন্ধী ফুলের দিকে যেমন ছুটে আসে মৌমাছির দল। ঠিক তেমন ভাবেই তাঁর সুরেলা কণ্ঠ চুম্বকের মত টেনে আনত পথচারী মানুষদের। গোষ্ঠগোপাল গেয়ে যেতেন গান। দেদার বিক্রি হত মাজন কিংবা জড়িবুটি দিয়ে বানানো ওষুধ। সামান্য কিছু টাকা নিয়ে, রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরতেন ক্লান্ত অবসন্ন গোষ্ঠগোপাল। সেই সামান্য টাকা দিয়ে কোনও মতে সংসার চালাতেন গীতা দেবী।
নিদারুণ দারিদ্র সত্ত্বেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল গ্রামবাংলার হাটে মাঠে বাটে। তাঁর জড়তাহীন উচ্চারণ, অনায়াসে তার-সপ্তকে খেলা করা কণ্ঠ ক্রমশ সম্মোহিত করতে শুরু করেছিল মানুষকে। হাজার মানুষের ভিড়ে শিষ্যকে খুঁজে নিয়েছিলেন 'বাউল গুরু' সুবল দাস। বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটি দেশে যিনি বাউল গান পরিবেশন করেছিলেন। যাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন গৌরক্ষ্যাপা, পবন দাস বাউল, নিমাইচাঁদ বাউল ও পরবর্তীকালে কার্তিক দাস বাউল। সেই সুবল দাস বাউল নদীয়ার আড়ংঘাটায় একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিলেন গোষ্ঠগোপালকে। প্রথম আবির্ভাবেই শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন গোষ্ঠগোপাল। বাংলা চিনেছিল বাউল সঙ্গীতের আকাশে সদ্য জেগে ওঠা এক ধ্রুবতারাকে।
গোষ্ঠগোপালের গান নেশা ধরিয়েছিল নেপাল দাস বাউলের মনে। তিনি গোষ্ঠগোপালকে নিয়ে এসেছিলেন নদীয়ার বগুলায়। পশ্চিমপাড়ার ধানহাটায় স্থায়ীভাবে ঘর বেঁধেছিলেন স্বভাবে বোহেমিয়ান গোষ্ঠগোপাল। তাঁর ধানহাটার কুটির হয়ে উঠেছিল ক্ষ্যাপা বাউলদের আখড়া। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি গোষ্ঠগোপালকে। হাতে খমক, কপালে রসকলি, খোঁপা করে বাঁধা চুল, সুঠাম সুদর্শন গেরুয়াধারী গোষ্ঠগোপালের গানের নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল গ্রামবাংলা। সেই সময় গ্রামবাংলার এমন কোনও জায়গা ছিল না, যেখানে পা পড়েনি গোষ্ঠগোপালের।
বাউল সংগীতের আকাশ আলো করে থাকা উজ্জ্বল নক্ষত্রদের ভিড়ে, নতুন নক্ষত্রকে চিনতে ভুল করেননি গীতিকার পরিতোষ দাস, গীতিকার-সুরকার নীলকমল রায় ও চন্দ্রকান্ত নন্দী। তখন ছিল ক্যাসেটের যুগ। করণ-কিরণ ও গাথানি কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল গোষ্ঠগোপালের গানের ক্যাসেট। বাজারে আসা মাত্র সুপার হিট হয়েছিল প্রত্যেকটি ক্যাসেট।
শহরে তেমন বিক্রি হত না। কিন্তু গ্রাম গঞ্জ, মফঃস্বল ও শহরতলির ক্যাসেটের দোকানগুলি থেকে ক্রিস্টমাসের কেকের মত বিক্রি হতে শুরু করেছিল ক্যাসেটগুলি। খুচরো বিক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে উঠেছিল কোম্পানিগুলি। প্রায় উল্কাগতিতেই গ্রামবাংলার প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন গোষ্ঠগোপাল। তাঁর গাওয়া "ট্যাংরা তবু কাটন যায়" গানটি শোনেননি, এমন মানুষ সেই সময় গ্রাম বাংলায় ছিলেন না।
গ্রামবাংলার মানুষের মনে দোলা লাগাতে শুরু করেছিল গোষ্ঠগোপালের গাওয়া,"গুরু না ভজি মুই", "চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে", "ঘুমায়ো না আর বেহুলা", "হায় রে এমন জ্বালা", "ইঁদুর মারার কল রয়েছে", "পাখি যখন দেবে উড়াল", "দম ফুরালে যাবো মিশে", "ওরে হাড় মোর জ্বলিয়া গেল", "আর যাব না রথের মেলাতে", "আমার বউ আমার কথা শোনে না", "জয় শিব শঙ্কর পরম ঈশ্বর", "কেহ আমায় দিল ব্যাথা", "আমার বন্ধু রইল কোনবা দেশে","পরাণ বন্ধু রে", "পিরীত হল ভাঙ ধুতুরার ফুল", "আমার বাউল ঘরে জনম যেন হয় গো বারে বার" সহ অজস্র কালজয়ী গান।
সেই যুগে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন গোষ্ঠগোপাল, তিনি মঞ্চে গান গাওয়ার পর গান গাইতে সাহস পেতেন না তখনকার দিনের প্রথিতযশা শিল্পীরাও। গোষ্ঠগোপাল নাইটের ভিড় সামলাতে নামাতে হত পুলিশ। খ্যাতির মধ্যগগনে গোষ্ঠগোপাল গান গেয়েছিলেন আকাশবাণী ও কলকাতা দূরদর্শনে। গানে গানে মাতোয়ারা করে দিয়েছিলেন লন্ডনের শ্রোতাদেরও। তবুও এক অজানা কারণে গোষ্ঠগোপাল ব্রাত্য থেকে গিয়েছিলেন শহরের অন্দরমহলে। শহরের গলিপথে বেজে উঠেছে তাঁর সম্মোহনী কণ্ঠ, এমন ঘটনা বিরল।
১৯৮৪ সালে ঘটেছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। কান্নাভেজা গলায় গোষ্ঠগোপাল গেয়ে উঠেছিলেন " অক্টোবরের একত্রিশ, উনিশশো চুরাশি, বুধবার দুপুরে হায়রে, কি নিদারুণ খবর পেলো ভারতবাসী বেতারে।" সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল গানটি। শোনা যায় পরবর্তীকালে শিল্পীকে পুরষ্কৃত করতে চেয়েছিল দিল্লি। সবিনয়ে সেই পুরষ্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গোষ্ঠগোপাল। জাতির এই মর্মান্তিক অধ্যায়ে নিজেকে গৌরবান্বিত করতে চাননি, মরমী বাউল গোষ্ঠগোপাল।
সহজ সরল মানুষটি কোনওদিন ভাবেননি সংগীতের জগতেও রাজনীতি আছে। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাই তাঁর কাল হতে শুরু করেছে। তাঁর উল্কাসম উত্থান, ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। তাঁর ভাবনাকে সত্যি করে, গোষ্ঠগোপালের জীবনে অচিরেই নেমে এসেছিল গ্রহণ। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন গোষ্ঠগোপাল। ভবিতব্যে বিশ্বাস করা গোষ্ঠগোপাল গেয়েছিলেন সেই অমর হয়ে যাওয়া গান, "জীবন নদীর ঘূর্ণি পাকে আর কতকাল বাইবি খেয়া মন।"
নিজের প্রতিভার কদরও করেননি কোনওদিন। প্রচুর রোজগার করেও ধরে রাখতে পারেনি কিছুই। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে গোষ্ঠগোপালকে গ্রাস করেছিল তীব্র অর্থকষ্ট। দুঃখ ভুলতে আশ্রয় নিয়েছিলেন নেশার কাছে। বুঝতে পেরেছিলেন খাঁচার ভিতর অচিন পাখিটা সময়ের আগেই উড়ে যাবে। তাই বুঝি মৃত্যুর বহু আগে গেয়ে রেখেছিলেন, শ্রী শ্রী প্রণবানন্দ মহারাজের লেখা ও সুর করা গান,"খেলা শেষ তোর করে নে মন, যাওয়ার দিনের দেরি নাই।" ১৯৮৬ সালের ৪ ডিসেম্বর। দুই স্ত্রী, এক পুত্র, তিন কন্যা ও কোটি কোটি গুণমুগ্ধ শ্রোতাকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলেন গোষ্ঠগোপাল। সময়ের অনেক আগেই। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে।
গোষ্ঠগোপাল দাসের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে প্রায় চার দশক। আজ যখন রাতের আঁধারে শহর কাঁপায় হায়াবুশা ও ফেরারির দল। হনি সিংয়ের "পার্টি অল নাইট' গানের তালে নাচতে থাকে সাইকাডেলিক আলো, ঠিক তখনই গ্রামবাংলার কোনও খেয়াঘাটে রাতজাগা প্রৌঢ় চা দোকানি, হাতে তুলে নেন অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রাখা বিবর্ণ এক ক্যাসেট। রাতচরা পাখি হয়ে গোষ্ঠগোপাল গেয়ে ওঠেন, "আমি এমন মানুষ পেলাম না রে, যে আমায় ব্যথা দিলো না।" অশ্রুসজল চোখে গ্রামবাংলা বলে ওঠে, "বন্ধু আর এক বার আসিয়া। যাও মোরে দেখিয়া। আমি নয়ন ভরে একবার দেখতে চাই।"
তথ্যসূত্রঃ গোষ্ঠগোপাল দাসের ভাবশিষ্য ও লোক সঙ্গীত শিল্পী সত্যরঞ্জন মণ্ডল , বগুলা রক্স
চিত্র কৃতজ্ঞতাঃসত্যরঞ্জন মণ্ডল , সোশ্যাল মিডিয়া